অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে - অংশীদারি চুক্তিপত্র কি

প্রিয় পাঠক আসসালামু আলাইকুম। অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে এবং অংশীদারি চুক্তিপত্র কি? আপনি কি এ সম্পর্কে জানতে চান। আমরা এই আর্টিকেলে অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে, অংশীদারি চুক্তিপত্র কি সহ আরো ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরেছি। অংশীদারি ব্যবসায়ী কাকে বলে এবং এ সম্পর্কে সব তথ্য এই আর্টিকালের মাধ্যমে জেনে নিতে পারবেন।
অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে
প্রিয় পাঠক অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে এবং অংশীদারি চুক্তিপত্র কি এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমাদের আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে সম্পূর্ণ পড়ুন। চলুন তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে শুরু করা যাক।

সূচিপত্রঃ অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে - অংশীদারি চুক্তিপত্র কি

  • ভূমিকা
  • অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে
  • অংশীদারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য
  • অংশীদারি ব্যবসায়ের গঠন প্রণালী
  • অংশীদারি চুক্তিপত্র কি
  • অংশীদারি ব্যবসায়ের প্রকারভেদ
  • অংশীদারি ব্যবসায়ের সুবিধা ও অসুবিধা
  • শেষ কথাঃ অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে - অংশীদারি চুক্তিপত্র কি

ভূমিকা

মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। একে অন্যের সাথে মিলে চলাই তার প্রকৃতি। নানান প্রয়োজনে যেমনি মানুষ একত্রিত হয় তেমনি ব্যবসায়ের প্রয়োজনেও বিভিন্ন ব্যক্তির সম্মিলন লক্ষণীয়। একমালিকানার ভিত্তিতে ব্যবসায় শুরু হলেও পরবর্তীতে ব্যবসায়ের পরিসর বৃদ্ধি পায়। একক ব্যক্তির মূলধন ও পরিচালনাগত সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার কারণে এই বাড়তি প্রয়োজন পূরণ অনেক সময়ই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একের অধিক ব্যক্তির সামর্থ্যের সম্মিলনে নতুন ধরনের ব্যবসায় সংগঠন অংশীদারি ব্যবসায় গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে নতুন নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সংগঠন গড়ে উঠলেও এখনও শহরে ও গ্রামে-গঞ্জে অনেক অংশীদারি ব্যবসায় গঠিত ও পরিচালিত হতে দেখা যায়।

অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে

চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কের ভিত্তিতে একাধিক ব্যক্তি কর্তৃক গঠিত ও পরিচালিত ব্যবসায়কে অংশীদারি ব্যবসায় বলে । একমালিকানা ব্যবসায়ের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে অধিক ব্যবসায় সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য এরূপ ব্যবসায়ের উদ্ভব। যৌথ সামর্থ্যকে একত্রিত করে তুলনামূলকভাবে বৃহদায়তন ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা এর লক্ষ্য। বাংলাদেশে বহাল ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, সকলের দ্বারা বা সকলের পক্ষে একজনের দ্বারা পরিচালিত ব্যবসায়ের মুনাফা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের নিমিত্তে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিবর্গ যে ব্যবসায় গঠন করে তাকে অংশীদারি ব্যবসায় বলে।


আইন অনুযায়ী সাধারণ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ জন ও ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ জন সদস্য এতে থাকতে পারে। চুক্তিই অংশীদারি ব্যবসায়ের ভিত্তি। অর্থাৎ ব্যবসায় পরিচালনাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তিই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অংশীদারদের মধ্যে অন্য সম্পর্কও থাকতে পারে তবে ব্যবসায় পরিচালনায় তার গুরুত্ব কম । অংশীদারি আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, অংশীদারি সম্পর্ক চুক্তি হতে জন্মলাভ করে; সামাজিক বা উত্তরাধিকারীর বলে নয়।

হাবিব বক্স বনাম স্যামুয়েল ফিজ এন্ড কোম্পানি নামক মোকদ্দমায় দেখা যায়, পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে একটা দোকান প্রাপ্ত হয়ে তিন ভাই তা মিলে-মিশে চালায় এবং লাভ হলে ভাগ করে নেয়। পরবর্তীতে এ ব্যবসায়টি অংশীদারি ব্যবসায় কি না প্রশ্ন উঠলে আদালত রায় দেয়, এটি অংশীদারি ব্যবসায় নয়। কারণ চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক এখানে মুখ্য নয়। বাংলাদেশে ১৯৩২ সালের অংশীদারি আইন অনুযায়ী এ ধরনের ব্যবসায় নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

অংশীদারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য

বর্তমান প্রেক্ষাপটে অংশীদারি ব্যবসায় একটি প্রাচীন ধরনের ব্যবসায় সংগঠন। যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এ ধরনের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান যা একে অন্য ব্যবসায় হতে স্বতন্ত্র রূপ দান করেছে নিম্নে এ সকল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
  1. একাধিক সদস্যঃ কমপক্ষে এ ধরনের ব্যবসায়ে দু'জন সদস্য (মালিক) থাকতে হয়। সাধারণ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২০ (বিশ) জন এবং ব্যাংকিং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১০ (দশ) জন সদস্য এতে থাকতে পারে।
  2. চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কঃ চুক্তিই অংশীদারি ব্যবসায়ের ভিত্তি। চুক্তির আলোকে অংশীদারদের মধ্যে যে সম্পর্কের সৃষ্টি হয় তাকেই চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক বলে। এরূপ সম্পর্কের আলোকেই এ ব্যবসায় গঠিত ও পরিচালিত হয়। অংশীদারদের মধ্যে অন্য সম্পর্কও থাকতে পারে তবে ব্যবসায় পরিচালনায় সেই সম্পর্ক মুখ্য বিবেচিত হয় না। ব্যবসায়ের কাজে বা নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক রক্ষা বা দায়-অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে চুক্তিবদ্ধ সম্পর্কই মুখ্য বিবেচিত হয়। এরূপ চুক্তি মৌখিক, লিখিত বা লিখিত ও নিবন্ধিত যেকোনো ধরনের হতে পারে।
  3. মূলধন সরবরাহঃ এ ব্যবসায়ের অংশীদারগণ চুক্তিতে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী মূলধন সরবরাহ করে । অবশ্য চুক্তিতে উল্লেখ থাকলে কেউ মূলধন বিনিয়োগ ছাড়াও অংশীদার হতে পারে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নির্ধারণের বেলায় অংশীদারদের সরবরাহকৃত মূলধন অনুযায়ী তা নির্ধারিত হয়ে থাকে।
  4. পরিচালনাঃ এ ব্যবসায় সকল অংশীদার কর্তৃক বা সকলের পক্ষে একজনের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে। [৪ (ধারা)]। অর্থাৎ ব্যবসায়ের সকল সাধারণ অংশীদার (যাদের দায় অসীম) এরূপ ব্যবসায়ের পরিচালনায় অংশ নিতে পারার অধিকারী। সীমিত দায়সম্পন্ন কোনো অংশীদার অবশ্য এরূপ ব্যবসায় পরিচালনায় অংশ নিতে পারে না।
  5. লাভ-ক্ষতি বণ্টনঃ চুক্তি অনুযায়ী এক্ষেত্রে অংশীদারগণের মধ্যে লাভ- ক্ষতি বণ্টিত হয়। চুক্তিপত্রে এ সম্পর্কে কোনো উল্লেখ না থাকলে মূলধনের পরিমাণ আর যা ই থাকুক না কেন সেক্ষেত্রে সমান হারে অংশীদারদের মধ্যে লাভ-ক্ষতি বণ্টন করা হয়ে থাকে।
  6. পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসঃ পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের মাধ্যমে এ ব্যবসায় যেমনি স্থাপিত হয় তেমনিভাবে ব্যবসায়ের সফলতার জন্যও এরূপ আস্থা বহাল থাকা আবশ্যক। আইনানুযায়ী এর অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও সদ্বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
  7. পারস্পরিক প্রতিনিধিত্বঃ আইনানুযায়ী এ ব্যবসায়ের অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিনিধিত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রতিনিধি ও মুখ্য ব্যক্তি হিসেবে গণ্য। ফলে ব্যবসায়ের পক্ষে প্রত্যেকের কৃতকার্যের জন্য অপর অংশীদার দায়বদ্ধ হয় । তবে ব্যবসায়ের প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত নয় এমন লেনদেনে প্রতিনিধিত্বের বিধান প্রযোজ্য নয়।
  8. আইনগত সত্তার অনুপস্থিতিঃ এ ব্যবসায় নিবন্ধিত হোক বা না হোক এর কোনো আইনগত সত্তার সৃষ্টি হয় না। ফলে ব্যবসায় নিজস্ব নামে পরিচিত ও পরিচালিত হতে পারে না। এর সকল লেনদেন ও চুক্তি অংশীদারদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদন করা হয়েছে বলে ধরা হয়।
  9. স্থায়িত্বের অনিশ্চয়তাঃ পৃথক আইনগত সত্তা না থাকায় এ ব্যবসায়ের - স্থায়িত্বের বিষয়টি বিশেষভাবে অংশীদারদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়াও অংশীদারদের কারও মৃত্যু, ভুল বোঝাবুঝি ইত্যাদি নানান কারণে এরূপ ব্যবসায়ের সহজে বিলোপ ঘটে।

অংশীদারি ব্যবসায়ের গঠন প্রণালী

অংশীদারি ব্যবসায় একটি প্রাচীন ও সহজ প্রকৃতির ব্যবসায় সংগঠন। এর গঠনেও তেমন কোনো আইনগত জটিলতা নেই । চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতাসম্পন্ন কমপক্ষে দু'জন ব্যক্তি মুনাফা অর্জন ও তা নিজেদের মধ্যে বণ্টনের নিমিত্তে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এরূপ ব্যবসায় গঠন করতে পারে। এরূপ চুক্তি লিখিত হওয়ারও কোনো আবশ্যকতা নেই। মৌখিক চুক্তিই এক্ষেত্রে যথেষ্ট বিবেচিত হয়।


তবে ভবিষ্যৎ বিবাদ-বিসংবাদ এড়ানোর জন্য এরূপ চুক্তি লিখিত এবং আরো অধিক সতর্কতার জন্য লিখিত ও নিবন্ধিত হতে পারে। অবশ্য মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতে গঠিত অংশীদারি ব্যবসায় ইচ্ছা করলে পরে তাদের চুক্তি লিখে ও প্রয়োজনে নিবন্ধন করে চুক্তির আইনগত বৈধতা বৃদ্ধি করতে পারে। দেশের আইন অনুযায়ী এরূপ ব্যবসায়ের জন্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয় ।

বাংলাদেশে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের অধীনে এরূপ ব্যবসায় পরিচালনা করতে চাইলে ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ আবশ্যক । ইদানিং ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও এরূপ ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হয়ে থাকে। অবশ্য ব্যবসায় গঠনের পরেও ট্রেড লাইসেন্স করা যায়। অংশীদার গ্রহণে এক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। ব্যক্তির সততা, আর্থিক সামর্থ্য, ব্যবসায় জ্ঞান ইত্যাদি দেখে অংশীদার গ্রহণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। তবে এ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য অবশ্যই বৈধ হওয়া আবশ্যক।

অংশীদারি চুক্তিপত্র কি

আইনের দ্বারা বলবৎযোগ্য সম্মতিকে চুক্তি বলে। অন্যদিকে অংশীদারদের মধ্যকার চুক্তির বিষয়বস্তু যে দলিলে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে অংশীদারি চুক্তিপত্র বলে। চুক্তিই অংশীদারে ব্যবসায়ের ভিত্তি । এরূপ চুক্তি মৌখিক, লিখিত এবং লিখিত ও নিবন্ধিত যে কোনো ধরনের হতে পারে। কিন্তু তা লিখিত হওয়ায় উত্তম। কারণ লিখিত চুক্তি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে ভুল বুঝাবুঝির কোনো অবকাশ এক্ষেত্রে থাকে না।

আদালতেও এরূপ দলিল প্রমাণ্য দলিলের মর্যাদা পায়। এরূপ চুক্তিপত্র বিশদ বর্ণিত হয় এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকালে উদ্ভূত হতে পারে এমন সকল সমস্যার প্রয়োজনীয় সমাধানের বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। অংশীদারি চুক্তিপত্র এরূপ ব্যবসায় পরিচলনায় যেহেতু মুখ্য ভূমিকা পালন করে তাই অংশীদারদের মধ্যকার ভবিষ্যৎ যে কোনো ভুল বুঝাবুঝিতে এরূপ দলিল যেন মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে সেভাবেই তা প্রণয়ন করা আবশ্যক।


এর মাধ্যমে এর প্রতিষ্ঠানের সকল অংশীদারের অধিকার, কর্তব্য ও দায়-দায়িত্ব নিরূপিত হয় । উল্লেখ্য অংশীদারি চুক্তিপত্রের কোনো ধারা আইন বিরুদ্ধ হওয়া উচিত নয়। এছাড়া অংশীদারি আইনের বিধান অনুযায়ী এটি লিপিবদ্ধ করা হলে ভবিষ্যৎ সমস্যা সমাধানে তা মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অংশীদারি চুক্তিপত্র এরূপ ব্যবসায় পরিচালনার ভবিষ্যৎ দিক-দর্শন হিসেবে কাজ করে।

অংশীদারি ব্যবসায়ের প্রকারভেদ

অংশীদারি ব্যবসায় সাধারণত দুই প্রকার হয়ে থাকে এগুলো হলঃ
  • সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায়
  • সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায়
সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায়ঃ অংশীদারের দায় সীমাহীন থাকে এবং ব্যবসায় পরিচালনায় প্রত্যেকেই অংশগ্রহণের অধিকারী হয় তাকে সাধারণ অংশীদারি ব্যবসায় বলে। এরূপ অংশীদারি ব্যবসায়ে সকল অংশীদারদের দায় তাদের বিনিয়োজিত মূলধন অপেক্ষা অধিক হয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি দায়বদ্ধ হয়। এরূপ দায়ের কারণে কোনো অংশীদার দেউলিয়া ঘোষিত হতে পারে। কেউ এরূপ দেউলিয়া ঘোষিত হলে উক্ত দেউলিয়া অংশীদারের ব্যবসায় সংক্রান্ত দায় স্বচ্ছল অংশীদারের ওপর বর্তে। এরূপ অংশীদারি ব্যবসায়ে কোনো অংশীদার এর পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নাও করতে পারে কিন্তু তার এই অধিকার সবসময়ই বহাল থাকে।

সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায়ঃ যদি কোনো অংশীদারি ব্যবসায়ে কোনো অংশীদারের দায় সীমিত বা সীমাবদ্ধ থাকে তাকে সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় বলে । অংশীদারি ব্যবসায়ের সাধারণ প্রকৃতি হলো এর অংশীদারদের দায় অসীম হয়। কিন্তু যদি কোনো অংশীদারি ব্যবসায়ে এর এক বা একাধিক সদস্যের দায় চুক্তি অনুযায়ী বা আইনগত কারণে সীমাবদ্ধ হয় তবে তা সীমাবদ্ধ অংশীদারি ব্যবসায় নামে অভিহিত হয়ে থাকে। তবে উল্লেখ্য, আইনানুযায়ী এরূপ অংশীদারি ব্যবসায়ে কমপক্ষে দু'জন অসীম দায়সম্পন্ন অংশীদার থাকা আবশ্যক । অন্যথায় উক্ত অংশীদারি ব্যবসায় গঠিত হতে বা টিকে থাকতে পারে না।

অংশীদারি ব্যবসায়ের সুবিধা ও অসুবিধা

অংশীদারি ব্যবসায়ের সুবিধা

অংশীদারি ব্যবসায় প্রাচীনকাল হতে চলে আসা ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের ব্যবসায় সংগঠন। এর এমন কিছু সুবিধা বিদ্যমান রয়েছে যার কারণে নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বর্তমানকাল অবধি এটা টিকে আছে। নিম্নে সুবিধাসমূহ বর্ণিত হলো-
  1. সহজ গঠনঃ আইনগত ঝামেলা না থাকায় এ ব্যবসায়ের গঠন বেশ সহজ। চুক্তি সম্পাদনের যোগ্যতাসম্পন্ন একাধিক ব্যক্তি মৌখিক বা লিখিত চুক্তি করে যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে সহজেই এ ব্যবসায় গঠন করতে পারে। তবে বাংলাদেশে সরকারি নিয়মানুসারে এরূপ ব্যবসায় পরিচালনার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হয়।
  2. অধিক মূলধনঃ এ ব্যবসায়ে একাধিক সদস্য থাকার ফলে এবং প্রয়োজনে সকলের সম্মতিক্রমে মূলধন' বৃদ্ধির সুযোগ থাকায় এক্ষেত্রে অধিক মূলধন যোগাড় সহজ হয় ও প্রয়োজনে ব্যবসায় সম্প্রসারণ করা যায় । একমালিকানা ব্যবসায়ের অনেক সুবিধা থাকার পরও একক মালিকের মূলধন প্রদানের সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতার কারণেই মূলত এরূপ ব্যবসায়ের উৎপত্তি।
  3. দলবদ্ধ প্ৰচেষ্টাঃ এক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যা একাধিক হওয়ায় দলবদ্ধ প্রচেষ্টার সুবিধা অর্জন করা যায়। সকল অংশীদারের স্বার্থ এক ও অভিন্ন হওয়ার কারণে সকলেই দলবদ্ধভাবে ব্যবসায়ের সফলতার জন্য কাজ করে । বিভিন্ন যোগ্যতায় সমন্বয় ঘটায় ও দায়িত্ব ভাগ করে নেয়ার সুযোগে এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ই ব্যবসায়ের উন্নয়ন সহজ হয়।
  4. সম্মিলিত সিদ্ধান্তঃ এরূপ ব্যবসায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সকল অংশীদারের মত প্রদানের সুযোগ থাকে। সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসৃত হয়। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকলের ইতিবাচক মতের প্রয়োজন পড়ে । ফলে এক্ষেত্রে একক ব্যক্তির আবেগ ও সীমাবদ্ধতা দূর করে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন সহজ হয়।
  5. ঝুঁকি বণ্টনঃ চুক্তিতে উল্লেখ লাভ-ক্ষতি বণ্টন হার অনুযায়ী, অন্যথায় সমান হারে বা মূলধন অনুপাতে ব্যবসায়ের যেকোনো প্রকার ক্ষতি বা ঝুঁকি অংশীদারদের মধ্যে বণ্টিত হওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করা সহজ হয়। এতে ব্যবসায়ের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।
  6. আইনগত ঝামেলা মুক্ততাঃ এ ব্যবসায়কে কোম্পানির ন্যায় বিভিন্ন বিষয়ে আইনগত আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। ফলে আইনগত ঝামেলার বাইরে থেকে সহজেই এরূপ ব্যবসায় পরিচালনা করা যায়।
  7. অসীম দায়ের পরোক্ষ সুবিধাঃ দায়ের মাত্রা বুঝে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের সতর্ক হয়ে চলার যে সুবিধা তাকেই অসীম দায়ের পরোক্ষ সুবিধা বলে । ব্যবসায়ে অংশীদারদের দায় অসীম হওয়ার কারণে সকল অংশীদার অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ব্যবসায় পরিচালনার চেষ্টা করে। ফলে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়সহ আবেগপ্রবণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। তদুপরি তৃতীয় পক্ষ এরূপ দায়ের সুবাদে ধার বা ঋণ প্রদানে আগ্রহী থাকে।
  8. জনসংযোগ সুবিধাঃ অংশীদারদের প্রত্যেকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচিতি, সুনাম ও বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বজায় থাকার কারণে ব্যবসায় অধিক জনসংযোগের সুবিধা পায় । ফলে দ্রুত সুনাম অর্জন সম্ভব হয় ও কার্যক্ষেত্রে এর সুফল ভোগ করা যায়।

অংশীদারি ব্যবসায়ের অসুবিধা

অংশীদারি ব্যবসায়ের অনেকগুলো সুবিধা পরিলক্ষিত হলেও এর বেশ কিছু অসুবিধা লক্ষণীয়। যার কারণে অদ্যাবধি এটি তেমন কার্যকরী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠেনি । নিম্নে এর অসুবিধাসমূহ আলোচিত হলো-
  1. সীমাহীন দায়ঃ আইনানুযায়ী এ ব্যবসায়ের অংশীদারদের দায় অসীম । অর্থাৎ ব্যবসায়ে বিনিয়োগকৃত মূলধনের বাইরেও অংশীদারদের ব্যক্তিগত দায় জন্মে। কোনো দেউলিয়া অংশীদারের দায়ও অন্যদের বহন করতে হয়। কোনো পাওনাদার যেকোনো অংশীদারের বিরুদ্ধে মামলা করে তার পাওনা আদায় করতে পারে। এ কারণে স্বচ্ছল ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা এরূপ ব্যবসায় গঠনে নিরুৎসাহ বোধ করে।
  2. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্বঃ এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সকল অংশীদারের মতামত গ্রহণ করতে হয় । একদিকে সবাইকে যথাসময়ে না পাওয়া অন্যদিকে মতের অমিল-এর কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময়ই বিলম্ব হয়। এরূপ বিলম্ব সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ালে সেক্ষেত্রে এ ব্যবসায় চালানো দুষ্কর হে পড়ে।
  3. পরিচালনায় জটিলতাঃ আইনানুযায়ী সকল অংশীদারই এ ব্যব পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। ব্যবসায় যখন সাধারণ মানে থাকে তখন অনেকে এ ব্যবসায় পরিচালনায় তেমন আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু ব্যবসায় ভালো করলে অযোগ্য অংশীদারও এরূপ অধিকার প্রয়োগে অনেক সময় এগিয়ে আসে। যার কারণে পরিচালনায় জটিলতা দেখা দেয়।
  4. অদক্ষ ব্যবস্থাপনাঃ অংশীদারদের অনেকের দায়িত্ব পালনে অনাহা, ক্ষেত্র বিশেষে অন্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসুবিধা, পরিচালনাগত জটিলতা ও ব্যবসায় পরিচালনার জন্য ন্যায্য পারিশ্রমিকের অভাব ইত্যাদি কারণে এ ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনা প্রায়শই অদক্ষ হয়। যৌথ দায়িত্বের কারণে দায়িত্ব পালনে অনীহা ও অন্যের ওপর দায় চাপানোর প্রবণতাও এক্ষেত্রে লক্ষনীয়।
  5. মূলধনের সীমাবদ্ধতাঃ সীমিত সদস্য সংখ্যা, মূলধন সংগ্রহে পদ্ধতিগত অসুবিধা, অংশীদারদের অসীম দায় ইত্যাদি কারণে প্রয়োজনীয় মুহূর্তেও এ ব্যবসায়ে মূলধন সংগ্রহ করা যায় না। যৌথ দায়িত্বের কারণে কেউ এককভাবে মূলধন সরবরাহে এগিয়ে আসে না। এ কারণে ঋণ সংগ্রহেও অসুবিধা হয়। তাই ব্যবসায়ের সম্ভাবনা ভালো থাকলে সেক্ষেত্রে অংশীদারদের মধ্যে কোম্পানি গঠনের আগ্রহ লক্ষ করা যায়।
  6. পারস্পরিক সদ্বিশ্বাসের অভাবঃ কাম্যমানের পারস্পরিক আস্থা ও সদ্বিশ্বাস না থাকলে এ ধরনের ব্যবসায় পরিচালনা করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে পরবর্তী সময়ে অনেকক্ষেত্রে নানান কারণেই অংশীদারদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস হ্রাস পায়। স্বার্থের সংঘাত একবার দেখা দিলে অবিশ্বাস ভিতর থেকে অংশীদারদের মধ্যকার সম্পর্ক নিঃশেষ করে ফেলে। এতে ব্যবসায় পরিচালনাতেই শুধু সমস্যা হয় না এর বিলোপও অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।
  7. স্বাধীন সত্তার অভাবঃ স্বাধীন সত্তা বলতে মালিকদের সত্তা থেকে ব্যবসায়ের সত্তা বা অস্তিত্বের ভিন্নতাকে বুঝায় । যার বলে ব্যবসায় নিজ নামে পরিচিত ও পরিচালিত হতে পারে। অংশীদারি ব্যবসায়ের পৃথক স্বাধীনসত্তা না থাকার কারণে এ ব্যবসায় নিজ নামে পরিচিত ও পরিচালিত হতে পারে না । তাই চুক্তি সম্পাদন, মামলা পরিচালনা ইত্যাদি কাজে সকল অংশীদারের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। অথচ বাস্তবে তা সবসময় সম্ভব হয় না।
  8. মালিকানা হস্তান্তরে অসুবিধাঃ অংশীদাররা এরূপ ব্যবসায়ের মালিকানা অবাধে হস্তান্তর করতে পারে না। সকল অংশীদারের সম্মতিক্রমে সুবিধামতো মালিকানা হস্তান্তর অনেক সময়ই সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আইনগত অসুবিধার কারণে তৃতীয় পক্ষও এটা ক্রয়ে তেমন উৎসাহী হয় না । ফলে অবসর গ্রহণে ইচ্ছুক অংশীদারকে অনেক সময়ই অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয় ।
  9. স্থায়িত্বের অনিশ্চয়তাঃ এরূপ ব্যবসায়ের স্থায়িত্ব অনিশ্চিত প্রকৃতির। অংশীদারের মৃত্যু, মস্তিষ্ক বিকৃতি, দেউলিয়াত্ব, পারস্পরিক বিরোধ বা অন্য যেকোনো কারণেই এর বিলোপ ঘটতে পারে। ফলে এরূপ ব্যবসায় কখনই জনআস্থা অর্জন করতে পারে না। অংশীদার, পাওনাদারসহ সংশ্লিষ্টদের মনে এরূপ ভীতি ব্যবসায়ের স্বাভাবিক অগ্রগতি অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে।

শেষ কথাঃ অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে - অংশীদারি চুক্তিপত্র কি

প্রিয় পাঠক আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম অংশীদারি ব্যবসায় কাকে বলে, অংশীদারি ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য, অংশীদারি ব্যবসায়ের প্রকারভেদ, অংশীদারি চুক্তিপত্র কি সহ আরো ইত্যাদি বিষয়ে। আশা করি উক্ত আর্টিকেল এর মাধ্যমে অংশীদারি ব্যবসায় সম্পর্কে বিস্তারিত সব তথ্য জানতে পেরেছেন।আর্টিকেলটি ভালো লাগলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার কোন মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করুন। আমরা নিয়মিত আমাদের ওয়েবসাইট থেকে নতুন নতুন আর্টিকেল পাবলিশ করে থাকি। আমাদের সাথে থাকুন। আল্লাহ হাফেজ। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url