খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন বিস্তারিত জেনে নিন

আপনি কি জানেন খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন। প্রিয় পাঠক আজকে আমরা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানবো খতিয়ান কাকে বলে এবং খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন। হিসাববিজ্ঞানে খতিয়ানের গুরুত্ব অন্যতম আশা করি খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন তা জেনে রাখলে আপনাদের উপকারে আসবে।
খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন
প্রিয় পাঠক খতিয়ান কে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন এ সম্পর্কে আপনি যদি জানতে ইচ্ছুক হন তাহলে আমাদের আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে সম্পূর্ণ শেষ পর্যন্ত পড়ুন। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে মূল বিষয়ে যাওয়া যাক।

সূচিপত্রঃ খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন বিস্তারিত জেনে নিন

ভূমিকাঃ খতিয়ান কাকে বলে

ইংরেজি ‘লেজ' (Ledge) শব্দের অর্থ 'তাক'। এই 'লেজ' (Ledge) শব্দ হতে 'লেজার' (Ledger) বা 'খতিয়ান' কথাটির উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। গৃহস্থালির বিভিন্ন প্রকারের জিনিসপত্র তাকে সাজিয়ে রাখা হয়। হিসাবরক্ষণ পদ্ধতিতে 'লেজারকে' অনেকটা তাকের মতোই বলা যায়। তাক-এ যেমন বিভিন্ন প্রকারের জিনিসপত্র থাকে থাকে সাজিয়ে রাখা হয়, খতিয়ান বা লেজারেও ঠিক তেমনি ব্যবসায়ের বিভিন্ন লেনদেনসমূহ শ্রেণিবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়।

লেনদেনসমূহ সম্পাদিত হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম অবস্থায় কোনো রকম বাছ-বিচার না করে তারিখ অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে এদেরকে হিসাবের প্রাথমিক বই জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু জাবেদা হতে লেনদেনসমূহের ফলাফল নিরূপণ সম্ভব হয় না। অর্থাৎ কোন খাতে কত টাকা আয় হয়েছে, কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, ব্যবসায়ের মোট পাওনা কত বা মোট দেনা কত, মোট কত টাকার সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে ইত্যাদি বিষয় জাবেদা হতে জানা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুনঃ জাবেদা কাকে বলে
কাজেই বিভিন্ন বিষয়ের জন্য পৃথক পৃষ্ঠায় ভিন্ন ভিন্ন হিসাব খুলতে হয় এবং লেনদেনগুলোকে জাবেদা হতে স্থানান্তরিত করে শ্রেণিবদ্ধ ও পাকাপাকিভাবে পুনরায় লেজার বা খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করতে হয়। অর্থাৎ যে বইয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় লেনদেন শ্রেণিবদ্ধভাবে সাজিয়ে সংক্ষিপ্তাকারে ও পাকাপাকিভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় তাকে খতিয়ান (Ledger) বলে। প্রথম পর্যায়ে লেনদেনগুলো সংঘটিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কোনোরূপ বাছ-বিচার না করে তারিখ অনুযায়ী পর পর জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়।

আর দ্বিতীয় পর্যায়ে জাবেদায় উল্লিখিত সকল লেনদেন এদের প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করে সংক্ষিপ্তাকারে এবং পাকাপাকিভাবে খতিয়ানে তোলা হয়। লেজার বা খতিয়ান হতে যেকোনো সময় একটি ব্যবসায়ের যাবতীয় দেনা-পাওনা, আয়-ব্যয়, সম্পত্তি-দায় ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সকল প্রকার লেনদেন শেষ পর্যন্ত খতিয়ানে স্থায়ীভাবে রাখা হয় বলে একে চূড়ান্ত হিসাবের বই (Book of final entry) হিসেবেও অভিহিত করা হয়।
গুরুত্ব অনুযায়ী জাবেদা হতে এটির প্রয়োজন অনেক বেশি। এ কারণে কেউ কেউ খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা (King of all books) বলেও অভিহিত করেন। উপরিউক্ত আলোচনা হতে পরিশেষে বলা যায় যে, হিসাবের যে পাকা বইতে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সকল লেনদেনসমূহ শ্রেণিবিন্যাস করে হিসাবের প্রাথমিক বই জাবেদা হতে সংক্ষিপ্ত আকারে ও শ্রেণিবন্ধ অবস্থায় পৃথক পৃথক শিরোনামে লিপিবদ্ধ করা হয় যাতে ব্যবসায়ের চূড়ান্ত ফলাফল যাচাই এবং আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা যায়, তাকে খতিয়ান বলে।

খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য কয়টি

খতিয়ান হলো সকল বইয়ের রাজা। খতিয়ান হতে হিসাবের আর্থিক ফলাফল সহজেই নিরূপণ করা যায়। নিচে খতিয়ানের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলোঃ
  • শিরোনামঃ খতিয়ানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি হিসাবখাতের জন্য পৃথক পৃথক শিরোনাম দেওয়া থাকে।
  • তারিখঃ খতিয়ানে লেনদেনসমূহ তারিখ অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়।
  • ডেবিট-ক্রেডিটঃ 'T' ফরমে প্রতিটি খতিয়ানের বামদিককে ডেবিট এবং ডানদিককে ক্রেডিট বলা হয়।
  • জাবেদা পৃষ্ঠাঃ জাবেদা থেকে লেনদেন খতিয়ানে স্থানান্তর করার সময় জাবেদা পৃষ্ঠা লেখা হয়।
  • টাকার পরিমাণঃ খতিয়ানের ডেবিট ও ক্রেডিট কলামে টাকার ঘরে টাকার পরিমাণ লিপিবদ্ধ করা হয়।
  • জের টানাঃ নির্দিষ্ট সময় শেষে প্রত্যেকটি খতিয়ানের ডেবিট ও ক্রেডিট দিকের পার্থক্য নির্ণয় করে জের বের করা হয়।
  • সমাপনী রেখা টানাঃ খতিয়ানের জের টানার পর উভয় দিকে মোট টাকার যোগফলের নিচে দুটি সমান্তরাপ রেখা (-) টেনে হিসাব সমাপ্ত করা হয়।
  • নির্দিষ্ট ছকঃ খতিয়ানের নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী অঙ্কন করতে হয়। সাধারণত দু'ধরনের ছক ব্যবহৃত হয়, "T" Form এবং Balancing Form.
  • ডেবিট ব্যালেন্স/ক্রেডিট ব্যালেন্সঃ খতিয়ানের ডেবিট দিক বড় হলে তাকে ডেবিট ব্যালেন্স এবং ক্রেডিট দিক বড় হলে তাকে ক্রেডিট ব্যালেন্স বলে। তবে জের বা ব্যালেন্স সবসময় উল্টো ঘরে বসে। অর্থাৎ, ডেবিট ব্যালেন্স ক্রেডিট দিকে এবং ক্রেডিট ব্যালেন্স ডেবিট দিকে বসিয়ে দু'দিক সমান করা হয়।
উপরিউক্ত বৈশিষ্টগুলোর জন্য খতিয়ানকে অন্যান্য বই অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বই বলে বিবেচনা করা হয়।

খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন

হিসাবের প্রাথমিক বই জাবেদায় ব্যবসায়ের সকল লেনদেন তারিখ অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু জাবেদা বই হতে লেনদেনের সামগ্রিক ফলাফল নিরূপণ করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে এ সমস্ত লেনদেন জাবেদা বই হতে খতিয়ান বইতে স্থানান্তর করতে হয়। খতিয়ানে এ সমস্ত লেনদেন স্থানান্তরকালে এদের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন শিরোনামে বিভক্ত করে সংক্ষিপ্তাকারে, শ্রেণিবদ্ধভাবে এবং স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় যেন কোনো নির্দিষ্ট সময় শেষে এদের সামগ্রিক ফলাফল নির্ণয় করা যায়। বলাবাহুল্য, লেনদেনগুলো খতিয়ানে তোলার পর জাবেদার আর বিশেষ প্রয়োজন হয় না।
আরও পড়ুনঃ শেয়ার কাকে বলে
সুতরাং ব্যবসায়ের ফলাফল নিরূপণের প্রশ্নে জাবেদা বইয়ের তুলনায় খতিয়ান বইয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। (Arthur Fieldhouse-এর মতে লেনদেনসমূহের স্থায়ী ভান্ডার (Permanent storehouses of all the transactions) অর্থাৎ একে বলা হয় হিসাবের পাকা বই (Book of final entry ) Wilham Pickles-এর মতে খতিয়ান হচ্ছে সাহায্যকারী বই-এর যাবতীয় দাখিলার গন্তব্যস্থল (The destination of all entries made in the subsidiary books)। এই সমস্ত কারণে খতিয়ান বইকে কেউ কেউ ‘সমস্ত বইয়ের রাজা' King of all books বলে আখ্যায়িত করেছেন।

উপরিউক্ত খতিয়ানের প্রতিটি হিসাবখাতকে হিসাব-নিকাশ সংক্রান্ত উপাত্তসমূহের এক একটি সংঘটিত ভান্ডার বলা হয়। 'An organised storge for accounting data' সুতরাং খতিয়ান হচ্ছে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। নিম্নলিখিত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে হাতিয়ানকে সকল বইরে রাজা বলা হয়-
  • কাঙ্ক্ষিত ফলাফলঃ লেনদেনগুলোর কাঙ্ক্ষিত ফলাফল খতিয়ান ছাড়া জাবেদার মাধ্যমে নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।
  • স্থায়ী ভাণ্ডারঃ খতিয়ান ব্যবসায়ের যাবতীয় লেনদেনের স্থায়ী ভান্ডার হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
  • হিসাবের শ্রেণিবিন্যাসঃ সকল প্রকার হিসাবকে সংক্ষিপ্ত ও শ্রেণিবিন্যাস করে খতিয়ানে পৃথক শিরোনামে সংরক্ষণ করার ফলে প্রত্যেক প্রকার হিসাবকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
  • আর্থিক চিত্রঃ খতিয়ান হতে ব্যবসায়ের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা অর্থাৎ আয়, ব্যয়, দায়, সম্পত্তি ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক বিবরণ সংগ্রহ করা যায়।
  • হিসাবের পাকা বা চূড়ান্ত বইঃ খতিয়ানকে হিসাবের পাকা বা চূড়ান্ত বই বলা হয়। কারন খতিয়ানেই লেনদেনসমূহের পাকা বা চূড়ান্ত রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয় এবং এটির সাহায্যে চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করা হয়।
  • গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাইঃ দু'তরফা দাখিলা হিসাব পদ্ধতি রেওয়ামিল তৈরি করে সংরক্ষিত হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা সম্ভব হয়।
  • সমস্যা সমাধানঃ কোনো লেনদেন বা হিসাব সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি বা সন্দেহ দেখা দিলে খতিয়ানের সাহায্যে তা নিরসন করা যায়।
  • চূড়ান্ত হিসাব প্রণয়নঃ বিভিন্ন হিসাবখাতের উদ্বৃত্তের সাহায্যে প্রস্তুতকৃত রেওয়ানি হতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর ব্যবসায়ের চূড়ান্ত হিসাব অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয় হিসাব, লাভ-লোকসান হিসাব এই উদ্বৃত্তপত্র তৈরি করে চূড়ান্ত ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা যায়।
  • ফলাফল পর্যালোচনাঃ ব্যবসায়ের সফলতা বা ব্যর্থতা পর্যালোচনা করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহে উৎসই হলো খতিয়ান।
  • দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতির প্রয়োগঃ খতিয়ানের মাধ্যমে হিসাবের বিজ্ঞানসম্মত ও সর্বজনগ্রাহ্য দু'তরফা দাখিলা পদ্ধতি ব্যবহার করে হিসাববিজ্ঞান ও আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন সম্ভব হয়।
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণঃ খতিয়ানের উদ্বৃত্তসমূহ দ্বারা প্রস্তুতকৃত চূড়ান্ত হিসাবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে। ব্যবসায় পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সহজ হয়।
  • খাতওয়ারী আয়-ব্যয় জানা যায়ঃ প্রতিটি আয়-ব্যয় খাতের জন্য খতিয়ানে আলাদা আলাদা হিসাব রাখা হয় ফলে খাতওয়ারী আয়-ব্যয় জানা যায়।
  • ভুল-ত্রুটি উদ্ঘাটন ও প্রতিরোধঃ লেনদেনসমূহ প্রাথমিক অবস্থায় জাবেলায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং পরবর্তীতে জাবেদা হতে খতিয়ানে স্থানান্তর করা হয়। এর ফলে ভুল-ত্রুটি সহজেই উদ্‌ঘাটিত হয়। এছাড়া খতিয়ানে হিসাবসমূহ তারিখের ক্রমানুসারে সরক্ষণ করা হয়। এর ফলে ভুল-ত্রুটি ও জালিয়াতি রোধে সহায়তা করে।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে পরিশেষে বলা যায় যে, খতিয়ানের গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে বাড়িয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। খতিয়ান আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের প্রধান প্রধান সকল উদ্দেশ্যই সাধন করে থাকে। খতিয়ান প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার দর্পণ বিশেষ। এটি ছাড়া অন্য কোনো বিষয় হতে উপরিউক্ত বিষয় জানা যায় না। কাজেই বাস্তব ক্ষেত্রে খতিয়ান অপরিহার্য আর এ কারণেই খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয়।

খতিয়ানের উদ্দেশ্য

প্রতিটি হিসাব তৈরি করার পিছনে একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য কাজ করে। নিচে খতিয়ানের প্রধান প্রধান উদ্দেশ্য আলোচনা করা হলো-
  • লেনদেনের স্থায়ী লিপিবদ্ধকরণঃ লেনদেনসমূহ স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করা খতিয়ানের মাধ্যমেই সম্ভব।
  • শ্রেণিবিভাগঃ খতিয়ানের মাধ্যমে হিসাবসমূহকে পৃথক পৃথকভাবে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। ফলে হিসাবসমূহের ফলাফল নির্ণয় করা যায়।
  • গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাইঃ খতিয়ান হিসাবের উদ্বৃত্ত নিয়ে রেওয়ামিল তৈরি করে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়।
  • উদ্বৃত্ত নির্ণয়ঃ একটি নির্দিষ্ট সময় শেষে প্রতিটি হিসাবখাতের উদ্বৃত্ত নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে খতিয়ান তৈরি করা হয়।
  • চূড়ান্ত হিসাব প্রণয়নে সহায়তাঃ খতিয়ানের মাধ্যমে চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা জানা যায়।
  • সঠিক হিসাব-সরক্ষণঃ লেনদেনসমূহকে ডেবিট ও ক্রেডিট অনুযায়ী খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয়। ফলে সঠিক হিসাব সংরক্ষণ করা হয়।
  • জালিয়াতি রোধঃ খতিয়ান রাখলে হিসাবের জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব হয়।
  • আর্থিক প্রতিবেদন ও তথ্য সরবরাহঃ হিসাবকালের শেষ তারিখে চূড়ান্ত হিসাব প্রস্তুতের পর আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যায়। আর এ প্রতিবেদন থেকে নানাবিধ তথ্য পাওয়া যায়।
  • তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণঃ খতিয়ানে প্রতিবছরের লেনদেনসমূহ চূড়ান্ত ও পাকাপাকিভাবে রাখা হয় বলে চলতি বছরের বিভিন্ন তথ্যের সাথে বিগত বিভিন্ন বছরের অনুরূপ তথ্যের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়।
  • কাঙ্ক্ষিত ফলাফলঃ লেনদেনগুলোর কাঙ্ক্ষিত ফলাফল খতিয়ান ছাড়া জাবেদার মাধ্যমে নিরূপণ সম্ভব হয় না।
  • নীতি নির্ধারণঃ হিসাবসংক্রান্ত সকল প্রকার তথ্যাদি খতিয়ানে পাওয়া যায় বলে ব্যবসায়ের নীতি নির্ধারণে ও ব্যবসায় পরিচালনায় বিশেষ সুবিধা অর্জন করা যায়।
  • দুতরফা দাখিলা পদ্ধতি বাস্তবায়নঃ হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত দুতরফা দাখিলা পদ্ধতির প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ করাও খতিয়ান হিসাব প্রস্তুতের অন্যতম উদ্দেশ্য। এতে বিভিন্ন আইনগত বাধ্যবাধকতাও সম্পন্ন হয়।
পরিশেষে বলা যায়, খতিয়ান প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত হিসাব তৈরির মাধ্যমে আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করার প্রেক্ষিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বিধায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই খতিয়ান বই প্রস্তুত করা বাধ্যতামূলক।

খতিয়ানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর

হিসাবরক্ষণে খতিয়ানের গুরুত্ব অপরিসীম। খতিয়ানের মাধ্যমে হিসাবরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়ে থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে, হিসাবের প্রাথমিক বই জাবেদায় ব্যবসায়ের সকল লেনদেন তারিখের ক্রমানুসারে লেখা হয়। কিন্তু এ থেকে লেনদেনসমূহের সামগ্রিক ফলাফল জানা সম্ভব হয় না। পক্ষান্তরে, লেনদেনসমূহ জাবেদা হতে খতিয়ানে স্থানান্তরিত করার সময় লেনদেনসমূহের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে এমন সংক্ষিপ্ত ও শ্রেণিবদ্ধভাবে সাজিয়ে লেখা হয় যে, এদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে সামগ্রিক ফলাফল জানা সম্ভব হয়।
এই কারণে খতিয়ানকে “সকল বইয়ের রাজা" বা সেরা বই হিসেবে অভিহিত করা হয়। খতিয়ান হতে একটি ব্যবসায়ের দেনা-পাওনা, সম্পত্তি, আয়-ব্যয় ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় এবং এসব তথ্যের ভিত্তিতে চূড়ান্ত হিসাব (Final Accounts) প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যবসায়ের প্রকৃত আর্থিক অবস্থাও নির্ণয় করা সম্ভব হয়। অতএব, হিসাবরক্ষণের ক্ষেত্রে খতিয়ানের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। খতিয়ানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলো এবং সুবিধা নিচে উল্লেখ করা হলো-
  • পূর্ণাঙ্গ হিসাবঃ খতিয়ানের মাধ্যমে দু তরফা পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যবসায়ের পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাখা সম্ভব হয়।
  • লেনদেনের তথ্য জ্ঞানঃ বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পাদিত সকল লেনদেন খতিয়ানে প্রত্যেক ব্যক্তি রা প্রতিষ্ঠানের নামে পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয় বলে ব্যবসায়ী তার দেনা-পাওনা সম্পর্কে অবহিত থাকে।
  • চূড়ান্ত ফলাফল নির্ণয়ে সাহায্যঃ খতিয়ানে প্রতিটি আয়-ব্যয়ের উৎস সম্পর্কে পৃথক পৃথক হিসাব লেখা হয় বলে নির্দিষ্ট হিসাবকাল শেষে ব্যবসায়ীর পক্ষে আয়-ব্যয়ের সামগ্রিক ফলাফল অথবা লাভ-লোকসান নিরূপণ করা সম্ভব হয়।
  • আর্থিক অবস্থা জানাঃ সকল প্রকার সম্পত্তি-দায়, দেনা-পাওনা প্রভৃতি বিষয়ের পৃথক পৃথক হিসাব থাকার ফলে যেকোনো নির্দিষ্ট দিনে আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুত করে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অকাত হওয়া যায়।
  • নীতি নির্ধারণে সহায়তাঃ হিসাব সংক্রান্ত সকল প্রকার তথ্যাদি খতিয়ানে সুশৃঙ্খলভাবে পাওয়া যায় বলে ব্যবসায়ের নীতি নির্ধারণে ও ব্যবসায় পরিচালনায় বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়।
  • ভুল-ত্রুটি উদ্ঘাটনঃ খতিয়ানের সাহায্যে ব্যবসায়ের হিসাবরক্ষণের ভুল-ত্রুটি এবং জালিয়াতি উদ্ঘাটন ও সংশোধন করা যায়।
  • হিসাবের তথ্য সংগ্রহঃ খতিয়ানশ্চিত হিসাবগুলোর উদ্বৃত্তকরণের মাধ্যমে ব্যবসায়ের মোট কয়, মোট বিক্রয়, মোট পাওনাদার, মোট দেনাদার, বিভিন্ন খাতে মোট আয় ও মোট ব্যয় এবং বিভিন্ন সম্পত্তি মায়ের পরিমাণ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
  • আনুপাতিক বিশ্লেষণঃ খতিয়ানের হিসাবগুলোর উদ্বৃত্তের মাধ্যমে বিগত বছরের সাথে বর্তমান বছরের ক্রয়-বিক্রয়, লাভ-লোকসান এবং আর্থিক অবস্থার তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়। বিগত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরের নিট লাভ-ক্ষতির হ্রাস-বৃদ্ধি নির্ণয় করা যায়।
  • গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাইঃ খতিয়ানের বিভিন্ন হিসাবখাতসমূহের উদ্বৃত্তের সাহাযো রেওয়ামিল (Trail Balance) প্রস্তুত করা যায় বলে একদিকে যেমন হিসাবখাতসমূহের নির্ভুলতা যাচাই করা যায়, অপরদিকে এটি দ্বারা (রেওয়ামিল প্রস্তুত দ্বারা) ব্যবসায়কে চূড়ান্ত হিসাব প্রণয়ন করাও সহজসাধ্য হয়ে ওঠে।
  • পরিচ্ছন্ন হিসাব ব্যবস্থাঃ খতিয়ানে প্রতিটি লেনদেন নির্ভুল এবং পরিচ্ছন্নভাবে লিপিবদ্ধ করা যায়। লেনদেনগুলো জাবেদা বই হতে খতিয়ানে দ্বিতীয় পর্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয় বলে খতিয়ানের হিসাবথাতগুলোকে পরিচ্ছন্নভাবে লিপিবদ্ধ করা যায়। প্রতিটি লেনদেন সংক্ষিপ্তাকারে খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা হয়। এ কারণে খতিয়ানের হিসাবখাতের পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি পায়।
  • চূড়ান্ত হিসাব বইঃ খতিয়ানকে একটি পাকা হিসাব বা চূড়ান্ত বই বলা হয়। লেনদেনগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এগুলো জাবেদা হতে খতিয়ানে স্থানান্তরিত করা হয় বলে হিসাবখাতগুলোর নির্ভুলতা ও পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধি পায়। এই কাজ দুইবার করা হয় বলে খতিয়ানের কাজটি পাকাপোক্ত হয়। এ কারণে খতিয়ানকে পাকা হিসাবের বহিও বলা হয়।
  • অপরিহার্য হিসাব বইঃ খতিয়ান বই একটি অপরিহার্য হিসাব বই। খতিয়ানে লেনদেনসমূহ এদের প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিন্যাস করে শ্রেণিবদ্ধভাবে পৃথক পৃথক শিরোনামে লিপিবদ্ধ করা হয়। এটির ফলে প্রতিটি হিসাবখাত হতে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। প্রতিটি আয়-ব্যয়, দেনা-পাওনা, সম্পত্তি ও দায়ের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। অর্থাৎ এক কথায় কোনো নির্দিষ্ট সময়ান্তে ব্যবসায়ের নিট লাভ বা নিট লোকসান এবং সর্বাঙ্গীণ আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিকভাবে জ্ঞাত হওয়া যায়। এ সমস্ত কারণে খতিয়ানকে একটি অপরিহার্য হিসাব বই এবং সকল বইয়ের রাজারূপে আখ্যায়িত করা হয়।
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণঃ খতিয়ান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।
  • দুতরফা দাখিলা পদ্ধতির বাস্তবায়নঃ খতিয়ানের মাধ্যমে হিসাববিজ্ঞানের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত দুতরফা দাখিলা পদ্ধতির প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। এতে বিভিন্ন আইনগত আবশ্যকতাও সম্পন্ন হয় ।
  • স্থায়ী তথ্য ভাণ্ডারঃ ভবিষ্যতে যেকোনো প্রয়োজনে যেকোনো তথ্য খতিয়ান হতে সহজে উদঘাটন করা যায়। কারণ খতিয়ান হচ্ছে ব্যবসায়ের আর্থিক তথ্যের স্থায়ী ভাণ্ডার।
  • ব্যয় নিয়ন্ত্রণঃ ব্যয় সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকার তথ্য খতিয়ান হতে পাওয়া যায়। এর ফলে প্রয়োজনমতো বায় হ্রাস বা পরিহার করা যায়।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে পরিশেষে বলা যায় যে, খতিয়ানের গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে বাড়িয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। খতিয়ান হিসাবরক্ষণের সকল উদ্দেশ্য সাধন করে। খতিয়ান প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার দর্পণ বিশেষ। এটা ছাড়া অন্য কোনো বই হতে উপরিউক্ত বিষয় জানা সম্ভব হয় না। কাজেই বাস্তব ক্ষেত্রে খতিয়ান অপরিহার্য। আর এ কারণেই খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয়।

শেষ কথাঃ খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন বিস্তারিত জেনে নিন

প্রিয় পাঠক আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম খতিয়ান কাকে বলে, খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য, খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন, খতিয়ানের উদ্দেশ্য, খতিয়ানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে। আশা করি উক্ত আর্টিকেল এর মাধ্যমে খতিয়ান সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করতে পেরেছেন। পোস্টটি ভালো লাগলে অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। আপনার কোন মতামত থাকলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানান। এমন বিভিন্ন ধরনের ব্লগ পোস্ট পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি ভিজিট করতে পারেন। আমাদের সাথেই থাকুন, আল্লাহ হাফেজ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url