বাংলা রচনা : যৌতুক প্রথা
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক। সমাজে যে সকল অন্যান্য প্রথা প্রচলিত রয়েছে এর
মধ্যে ঘৃণিত প্রথা হচ্ছে যৌতুক প্রথা। আপনি যদি যৌতুক প্রথা বাংলা রচনাটি খুজে
থাকেন অথবা যৌতুক প্রথা কি এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক হয়ে থাকেন তাহলে
একদম সঠিক জায়গায় চলে এসেছেন।
কেননা আমরা এই আর্টিকেলটিতে আপনাদের জন্য যৌতুক প্রথা কি সহ আরও ইত্যাদি বিষয়
সমূহ রচনা আকারে তুলে ধরেছি। আপনি যদি যৌতুক প্রথা রচনাটি পড়তে ইচ্ছুক হয়ে
থাকেন তাহলে আমাদের এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে সম্পূর্ণ শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
যৌতুক প্রথা রচনাটির সংকেত সমূহ
ভূমিকা
আধুনিক সমাজে যৌতুক নামক ঘৃণ্য প্রথার অস্তিত্ব আছে কথাটি ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
যেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নারী-পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে আমাদের
দেশে এখনও নারীসমাজকে যৌতুকের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে হচ্ছে। যে নারী ঘরের
সৌন্দর্য ও শান্তির চির উৎস, সেই নারীকে আজ যৌতুকের দাবিতে অকথ্য নির্যাতন করা
হয়।
অভিশপ্ত যৌতুক প্রথার কারণ ও নারী নির্যাতন
আর্থিক দুরবস্থাও যৌতুক প্রথা সম্প্রসারিত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর একটি। এছাড়া
যৌতুক প্রথার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কারণ জড়িত। তার মধ্যে কুসংস্কার
ও অন্ধবিশ্বাস, সামাজিক প্রতিপত্তি ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহ, অজ্ঞতা, উচ্চাভিলাষী
জীবনযাপনের বাসনা, নারীদের আর্থনীতিক পরনির্ভরশীলতা, অধিকারহীনতা এবং অশিক্ষা
উল্লেখযোগ্য।
যৌতুক প্রথার নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও নারী নির্যাতন আজকাল সর্বজনবিদিত। জন অস্টিন
বলেছেন, 'Dowry system paves the way to woman oppression', বিভিন্ন গবেষণা ও
জরিপের মাধ্যমে দেখা গেছে, নারী বিশেষ করে বিবাহিত নারীদের ওপর নির্যাতন হয়
সবচেয়ে বেশি। আর এ নির্যাতনের অন্যতম কারণ যৌতুক।
উনবিংশ শতাব্দীতে নারীমুক্তি আন্দোলন
উনবিংশ শতাব্দীতে আমাদের জাতীয় জীবনে যে নবজাগরণের সূচনা হয় তা কুসংস্কার ও
রক্ষণশীলতায় ভগ্ন মুমূর্ষু সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও
পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার সংস্পর্শ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বহুলাংশে সাহায্য করে।
ফলে বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিরোধে সমাজসেবীরা তৎপর হলে এসব প্রথা বন্ধ হয়;
রাজা রামমোহন রায়ের চেষ্টায় সতীদাহ প্রথার বিলোপ ঘটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের
সচেষ্ট ভূমিকায় বিধবা বিবাহ চালু হয়। কিন্তু তারপরেও জাতির এই কুসংস্কার থেকে
বেরিয়ে আসার জোয়ারেও যৌতুকের মতো ঘৃণ্য প্রথাটির মূল উৎপাটিত হলো না।
'বর্তমানে যৌতুক প্রথার রূপ বদল
বর্তমানে যৌতুক প্রথা আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। আগে পণ্যের অর্থ হাতে হাতে
আদায় করার ব্যবস্থা ছিল। বিয়ের আসরেই পাত্রপক্ষ সব যৌতুকসামগ্রী বুঝে নিত এবং
দেনা-পাওনার ব্যাপারটা মিটে গেলে পাত্রকে বিয়ের আসরে আনা হতো।
এছাড়া, প্রাপ্য অর্থ বুঝে নেওয়ার সময় পাত্রীপক্ষের দিক থেকে চুক্তির কোনোরূপ
খেলাপ গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং শুধু এই অপরাধে বিয়েবাড়ি থেকে বর
উঠিয়ে নিয়ে যাওয়াটা ছিল অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বর্তমানে আসল ব্যাপারটা প্রায় কিছুই
বদলায়নি; শুধু সবকিছুর ওপর ভদ্রতার মুখোশ এঁটে দেওয়া হয়েছে। এখন অনেকেই শালীনতার
দোহাই দিয়ে নগদ অর্থ নিতে চান না।
এর পরিবর্তে প্রত্যাশা করে রঙিন টেলিভিশন, টেপ-রেকর্ডার, রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং
মেশিন, কম্পিউটার, মোটর সাইকেল, মোটর গাড়ি, ফ্ল্যাট বাড়ি কিংবা জমি-জায়গা
ইত্যাদি। আজকের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, শাসক-শোষক
নির্বিশেষে সবাই কম-বেশি এই হীন কাজটার সঙ্গে জড়িত।
সমাজে যৌতুকের ক্ষতিকর দিক
যৌতুকের কারণে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে চরম অস্থিরতা। যৌতুক প্রথা অত্যন্ত অমানবিক ও
জঘন্য একটি সামাজিক অপরাধ। এটি নারীর মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে। মানুষ হিসেবে
সমাজে নারীকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে যৌতুক প্রথা বড়ো একটি বাধা। যৌতুক প্রথার
দংশনে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো করেছে বিপর্যন্ত, সমাজকে করেছে কলুষিত, রাষ্ট্রকে
করেছে পশ্চাৎপদ এবং সভ্যতাকে করেছে কলঙ্কিত।
যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে আইন ও গৃহীত পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার নারীর অধিকার রক্ষায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। ঘোষিত হয়েছে
নারী উন্নয়নের ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত 'জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি'। এছাড়াও নারী
নির্যাতন বন্ধে খোলা হয়েছে জাতীয় অ্যাকশন প্লান। আইন ও বিচারের মাধ্যমে নারীর ওপর
সকল প্রকার নির্যাতন বন্ধে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আইন প্রণীত হয়েছে। যেমন- যৌতুক
বিরোধী আইন ১৯৮০, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ১৯৮৩,
বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯৮৪, মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ (সংশোধিত ১৯৮৫), পারিবারিক
আদালত আইন ১৯৮৫, সন্ত্রাস বিরোধী আইন ১৯৯২, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০
(সংশোধিত)। এছাড়া বিদ্যমান অন্যান্য আইনেও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
নেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। অতি সম্প্রতি অনুমোদিত হয়েছে নারী উন্নয়ন নীতিমালার
খসড়া। যৌতুকের বিরুদ্ধে নিশ্চিত করা হয়েছে শান্তির বিধান।
'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০' অনুযায়ী যৌতুকের কারণে যদি কোনো নারীর
মৃত্যু ঘটানো হয় তবে এর শান্তি মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করা হলে
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আহত করা হলে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। আহত করার চেষ্টা করা
হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের এবং সর্বনিম্ন ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং সকল ক্ষেত্রে
আর্থিক দন্ডের বিধান রয়েছে।
'যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০' অনুসারে যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া উভয়ই আইনত নিষিদ্ধ। এ আইন
অনুযায়ী, যৌতুকের শান্তির আওতাভুক্ত হবে- যৌতুক দাতা, যৌতুক গ্রহীতা, যৌতুক
আদান-প্রদানে সাহায্যকারী, যৌতুক আদান-প্রদানে কুপ্ররোচনাকারী। এরূপ অপরাধের
শান্তি ১ থেকে ৫ বছরের কারাদন্ড এবং অর্থদণ্ড।
যৌতুক রোধে আমাদের করণীয়
বর্তমানে নারী ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। নানাদিকে তার সাফল্যের স্বীকৃতি।
এরপরও যৌতুক প্রথা আজও এক সামাজিক ব্যাধি। এ জঘন্য ও ঘৃণ্য প্রথা রোধে যা দরকার
তা হলো সুস্থ মানসিকতা, বলিষ্ঠ জীবনবোধ এবং সমাজকল্যাণমূলক প্রকৃত গঠনশীল
দৃষ্টিভঙ্গি। সকল ধর্মে যৌতুক প্রদান ও গ্রহণ অসমর্থিত হলেও আমরা কেউ তা মানি না
বা মানতে চাই না।
আমাদের দেশে যৌতুকবিরোধী আইন আছে সত্য; কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। এর প্রধান
কারণ আমরা অর্থাৎ যারা যৌতুকের প্রতিবাদে সোচ্চার তারাই নিজের কন্যার সুখের কথা
চিন্তা করে বিয়ের সময় জামাইয়ের হাতে নগদ অর্থ ও জিনিসপত্র তুলে দেই। যৌতুক প্রথা
রোধে কাজটি কিছুতেই করা যাবে না।
উপসংহার
যৌতুক এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। যৌতুক প্রথা রোধ করতে পারলে আমাদের দেশের
সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়ে উঠবে। সমাজ থেকে অশান্তি ও কলহ চিরতরে দূরীভূত
হবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url