ব্যবসায় নৈতিকতা কি
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক। আপনি কি জানেন ব্যবসায় নৈতিকতা কি? যদি না জেনে
থাকেন তাহলে একদম সঠিক জায়গায় চলে এসেছেন কেননা আমরা আর্টিকেলটিতে আপনাদের জন্য
ব্যবসায় নৈতিকতা কি এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
আশা করি আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে আসবে। ব্যবসায় নৈতিকতা কি এছাড়াও ব্যবসায়িক
মূল্যবোধ অনৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে আমাদের আর্টিকেলটি
সম্পূর্ণ শেষ পর্যন্ত পড়ুন। চলুন তাহলে শুরু করা যাক।
সূচিপত্রঃ ব্যবসায় নৈতিকতা কি
ভূমিকা
সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিতের জ্ঞান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেজন্য
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। প্রত্যেক মানুষ নিজের জন্য নিজের সন্তান-সন্ততির জন্য
ভালো কিছু প্রত্যাশা করে। যা তার অন্যের জন্যও করা বা চাওয়া উচিত। এখানেই সামাজিক
দায়িত্ববোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রশ্ন।
কোনো ব্যবসায়ী যখন জেনে-বুঝে পরিবেশ দূষণ করে, ক্ষতিকারক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে
মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় তখন সে কতটা অনৈতিক ও অবিবেচকের মত কাজ করছে তা
সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারে না; মুনাফা অর্জনই তার কাছে হয়ে ওঠে মুখ্য। ক'দিন আগে
টেলিভিশনে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের এক অসুস্থ বৃদ্ধা মাকে দেখলাম।
যিনি তার তিন যুবক সন্তান হারিয়েছেন একে একে। পরে মৃত্যুর কারণ জানা গেল। তারা
ক্ষেতে কীটনাশক বিষ স্প্রের কাজ করতো। কিন্তু নাকে-মুখে কাপড় দিত না। এই বিষ
শরীরে ঢুকে প্রত্যেকেরই ক্যান্সারে মৃত্যু ঘটেছে। তাই ঝুঁকিমুক্ত ভাবে নিজে
বাঁচতে ও অন্যকে বাঁচাতে সবাইকে আরো সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।
ব্যবসায় নৈতিকতা কি
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উচিত-অনুচিত মেনে চলা বা ভালোকে গ্রহণ ও মন্দকে বর্জন করে
চলাই হলো ব্যবসায়ের নৈতিকতা। ব্যবসায় সমাজ বিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ শাখা
হওয়ায় এক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষয়টি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যবসায় সমাজের মানুষের একটা
গুরুত্বপূর্ণ উপজীবিকা।
মানুষ তার প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার জন্য ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল। তাই ব্যবসায়ী
যদি উচিত-অনুচিত না মানে, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ভুলে যায়, অস্বাস্থ্যকর পণ্য
উৎপাদন ও বিক্রয় করে, পরিবেশ দূষণ করে মূল্যবোধ হারায় তখন ঐ সমাজে ব্যবসায় নামক
পেশার সম্মান ও মর্যাদা যেমনি থাকে না তেমনি সাধারণ মানুষও প্রতারিত হতে হতে
ভালো-মন্দ জ্ঞান হারাতে থাকে।
ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনার সকল পর্যায়ে নৈতিক মানদণ্ড মেনে চলাকেই ব্যবসায়ে
নৈতিকতা নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। নিম্নে ব্যবসায়ে নৈতিকতার কিছু বিষয় উল্লেখ
করা হলো:
পালনীয় বিষয়
- বৈধ উপায়ে ব্যবসায় চালানো।
- সততা বজায় রাখা।
- শ্রমিক-কর্মীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করা।
- সকলের পাওনা যথাসময়ে পরিশোধ করা।
- প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য পক্ষের দায়িত্ব পালন করা।
- স্বগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা।
- পরিবেশ রক্ষায় সাধ্যমতো ভূমিকা রাখা।
- সরকারি নিয়ম-রীতি মেনে চলা।
- আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা; ইত্যাদি।
বর্জনীয় বিষয়
- প্রতারণা, শঠতা ও ধোকাবাজির আশ্রয় গ্রহণ না করা।
- ক্ষতিকর ও বেআইনি পণ্য উৎপাদন বা বিক্রয় না করা।
- বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করা।
- একচেটিয়া প্রবণতা পরিহার করা।
- মাপে কম না দেয়া।
- ক্ষতিকর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া।
- কর ও রাজস্ব ফাঁকি না দেয়া।
- আইন মেনে চলা; ইত্যাদি
ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বলতে কি বুঝায়
ব্যবসায়ের কোন কাজটি নৈতিক কোন কাজটি অনৈতিক, কোন কাজটি করা উচিত কোন কাজটি করা
অনুচিত, কোন কাজটি ভালো কোন কাজটি খারাপ ইত্যাদি সংক্রান্ত চিন্তা বোধ বা
উপলব্ধিকেই ব্যবসায়িক মূল্যবোধ বলা হয়ে থাকে।
দীর্ঘদিনের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা ইত্যাদির আলোকে ব্যক্তি, দল ও সমাজের মধ্যে
এরূপ বোধের সৃষ্টি হয় এবং তা সমাজের মানুষদের আচরণকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
এরূপ বোধ বা আচরণকে সমাজে মূল্যবান ও অনুকরণীয় বলে মনে করা হয়ে থাকে।
নৈতিকতার বিষয়টি স্থির ও সর্বত্রই গ্রহণযোগ্য বিষয়। দীর্ঘদিনে চলতে যেয়ে সকল
সমাজেই কিছু বিষয় পালনীয় ও কিছু বিষয় বর্জনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মিথ্যা
কথা না বলা, বড়দের সম্মান করা, পণ্যে ভেজাল না দেয়া, মাপে কম না দেয়া, শালীনতা
বজায় রাখা, অসহায়কে সহায়তা করা ইত্যাদি নৈতিকতার বিষয়।
এখন শালীনতা বলতে কী বুঝাবে এটা একেক সমাজে মূল্যবোধের কারণে পার্থক্য হবে। বড়দের
সম্মান করার ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি প্রযোজ্য। মূল্যবোধ দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠে; যা
ব্যক্তি সমাজ ও দল ভেদে পার্থক্য হয়। কিন্তু নৈতিকতার বিষয়ে এরূপ পার্থক্য হয় না।
অর্থাৎ নৈতিকতা সাধারণ বিষয়।
আর মূল্যবোধ ব্যক্তি, সমাজ, দল, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি নানান চলক (Variables) দ্বারা
প্রভাবিত হয়ে থাকে। নৈতিকতার পথে মানুষকে চলতে উৎসাহিত করতে একদিকে যেমনি দৃঢ়
সামাজিক অঙ্গীকার এবং আইনের শাসন ও এর প্রয়োগ প্রয়োজন তেমনি উন্নত মূল্যবোধ
প্রতিষ্ঠাও জরুরি।
আর যথাযথ মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সুশিক্ষার প্রসার, সামাজিক সম্প্রীতি এবং উত্তম
ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। সামাজিক অগ্রগতি এক পর্যায়ে
মানুষের মূল্যবোধের ধারায় পরিবর্তন আনে। একইভাবে নৈতিকতার অনুশীলনেও সমাজ অগ্রগতি
লাভ করে।
ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা
ব্যবসায় শুধুমাত্র একটা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় সারা বিশ্বেই তার এখন অবাধ
বিচরণ। তাই দেশের ভাবমূর্তি এবং সামর্থ্যও এই ব্যবসায়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাই
ব্যবসায় কতটা নীতি-নৈতিকতা মেনে পরিচালিত হচ্ছে তার ওপর সমাজের মানুষগুলোর
নৈতিকতার মান, জনগণের মন-মানসিকতা, সামাজিক সুস্থতা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা
ইত্যাদি নানান বিষয় নির্ভর করে। যে কারণে ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সমাজে
অনেক বেশি প্রয়োজন। নিম্নে এর কতিপয় কারণ তুলে ধরা হলো:
- ব্যক্তিক পরিশুদ্ধি অর্জনঃ একজন ব্যবসায়ী যখন লোভ-লালসা ভুলে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা মেনে ব্যবসায় করে তখন তার মধ্যে আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নির্মল মানসিক সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।
- স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সুরক্ষাঃ অবৈধ অস্ত্র বিক্রয় মানুষের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই ব্যবসায়ীদের মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এথেকে মানুষকে সুরক্ষা দিতে পারে।
- উত্তম পরিবেশ সুরক্ষাঃ নৈতিকতার শিক্ষাই ব্যবসায়ীদের পরিবেশ আইনের অনুসরণে ও উত্তম পরিবেশ সুরক্ষায় কার্যকর সহযোগিতা দিতে পারে।
- মানসিক প্রশান্তি প্রতিষ্ঠাঃ একজন মানুষ কী করছে, কী খাচ্ছে, তাকে ঠকানো হলো কি না- এগুলো নিয়ে যদি সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তায় থাকে তখন ঐ মানুষটির মানসিক প্রশাস্তি থাকে না। যখন বাজারে মরা মুরগীর গোশত, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ ও ক্যামিক্যাল দিয়ে পাকানো ফল বিক্রয় হয়, ফরমালিনের ছড়াছড়ি থাকে, সৃষ্টিকর্মের নকল হয় অবলীলায়, নকল ও ভেজাল পণ্য কমদামে বিক্রয় হয় তখন ভোক্তা, ক্রেতা ও বিক্রেতা কেউই মানসিক প্রশান্তিতে থাকতে পারে না। ব্যবসায়িক মূল্যবোধ ও নৈতিকতাই শুধু সে অবস্থায় মানুষের মধ্যে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
- সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাঃ একজন ব্যবসায়ী যখন গ্রাহককে ঠকায় তখন স্বভাবতই ঐ ব্যবসায়ীর প্রতি গ্রাহকের বিরূপ ধারণা জন্মে। একটা সমাজের অনেক ব্যবসায়ী যখন এ অন্যায় কাজটি করে তখন সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিই মানুষের বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা যদি নৈতিকতা মেনে চলে, কাউকে না ঠকায়, মিথ্যা কথা না বলে, মাপে কম না দেয়, কথা ও কাজে মিল রেখে চলে তখন গ্রাহকরা নির্দ্বিধায় ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে পারে। এতে সমাজে একটা সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
- জাতীয় ভাবমর্যাদা প্রতিষ্ঠাঃ জাতীয় ভাবমর্যাদা যে কোনো জাতির জন্য একটা বড় সম্পদ। ভালো ব্যবসায়ীরা দেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু ব্যবসায়ী যদি খারাপ হয়, বিদেশী ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতারণা করে তবে দেশের ভাবমূর্তি প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একবার বাংলাদেশের কিছু অসাধু চিংড়ি ব্যবসায়ী ওজন বাড়ানোর জন্য চিংড়ির মধ্যে লোহা ঢুকিয়ে বিদেশে বিক্রি করায় সম্ভাবনাময় চিংড়ি খাত যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা অপূরণীয়। ব্যবসায় নৈতিকতায় শুধুমাত্র এ ধরনের অবস্থা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে পারে।
- ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি অর্জনঃ ব্যবসায়ে দীর্ঘস্থায়ী সমৃদ্ধি অর্জনেও মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অনুসরণ আবশ্যক। অনেক সময়ই দেখা যায়, অবৈধ ব্যবসায়ী সীমিত সময়ের জন্য আর্থিকভাবে লাভবান হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার পক্ষে ব্যবসায়ে ভালো করা সম্ভব হয় না। এ ধরনের ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র নিজেদেরই ক্ষতি করে না একটা খাতের এমনকি দেশের ব্যবসায় অগ্রগতিকেও বাধাগ্রস্ত করে। অথচ যদি দেশের ব্যবসায়ীরা সৎ হয়, নীতি-নৈতিকতার অনুসরণ করে তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তিক ও সামগ্রিক ব্যবসায়িক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব হয়।
আমাদের শেষকথা
প্রিয় পাঠক আমাদের আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আশা করি আর্টিকেলটির মাধ্যমে আপনারা ব্যবসা নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে
বিস্তারিত বিভিন্ন তথ্য সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এমন বিভিন্ন বিষয়ে আর্টিকেল
পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটটি নিয়মিত ভিজিট করুন। আপনাদের সুস্থতা কামনা করে আজকের
মত আমি বিদায় নিচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url