রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি জেনে নিন
এখন চলছে রমজান মাস তাই পুরো বিশ্বই মাহে রমজান পালিত হচ্ছে। আমরা সকলেই জানি
প্রত্যেক মুসলমানদের জন্যই রমজান মাসে রোজা করা ফরজ। আমরা অনেকেই আছি যারা রোজা
করি কিন্তু রোজা ভঙ্গের কারণ সমূহ সম্পর্কে অবগত নয়।
ইসলামে মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা তৃতীয় স্থানে। ইসলামে রমজানের গুরুত্ব
অপরিসীম। আমি মুসলিম হিসেবে আমাদেরকে রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি এ বিষয়ে অবশ্যই
জেনে রাখা জরুরি। নিচে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে চলুন জেনে নেওয়া
যাক।
সূচিপত্রঃ রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি বিস্তারিত জেনে নিন
ভূমিকা
রোজা ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত। এটি মুসলমানদের
আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারণের ফলে
রোজা ভঙ্গ হয়ে যেতে পারে। অনেকেই সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে ভুল ধারণা পোষণ
করেন। তাই আজকের এই লেখায় আমরা "রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি?" প্রশ্নের বিস্তারিত
বিশ্লেষণ করবো। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি? সংক্ষিপ্ত উত্তর
মূলত, রোজা ভঙ্গের কারণ প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
- যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং কাজা ও কাফফারা উভয়ই দিতে হয়।
- যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় কিন্তু শুধু কাজা দিতে হয়, কাফফারা দিতে হয় না।
এছাড়া এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা রোজার জন্য মাকরুহ হলেও রোজা ভঙ্গ করে না। চলুন,
বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় এবং কাজা ও কাফফারা উভয়ই দিতে হয়
যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কিছু করে যা সরাসরি রোজা ভঙ্গের কারণ হয়, তাহলে তার
শুধু কাজা করলেই চলবে না, বরং কাফফারাও দিতে হবে। কাফফারা হলো- একজন গোলাম মুক্ত
করা, তা সম্ভব না হলে দুই মাস ধারাবাহিক রোজা রাখা, তাও সম্ভব না হলে ৬০ জন
গরিবকে খাওয়ানো। নিচে প্রধান কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলোঃ
ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার বা পানি পান করাঃ যদি কেউ রোজা থাকা অবস্থায় সচেতনভাবে
কোনো খাবার বা পানীয় গ্রহণ করে, তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে। এটি একটি গুরুতর বিষয়,
কারণ রোজার মৌলিক শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পানাহার থেকে বিরত থাকা। যারা
ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গ করে, তাদের শুধু সেই দিনের রোজার কাজা করাই যথেষ্ট নয়,
বরং তাদের কাফফারাও দিতে হবে, যা হলো একটানা ষাট দিন রোজা রাখা বা ষাটজন দরিদ্র
ব্যক্তিকে খাবার খাওয়ানো।
ইচ্ছাকৃতভাবে সহবাস করাঃ সুবহে সাদিক থেকে মাগরিব পর্যন্ত রোজাদার
ব্যক্তির জন্য যৌনসম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। যদি কেউ সচেতনভাবে এই সময়ে সহবাস
করে, তাহলে তার রোজা ভেঙে যাবে। এটি কেবল রোজা ভঙ্গের কারণ নয়, বরং এটি ইসলামে
একটি গুরুতর অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। এমন পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র কাজা যথেষ্ট
নয়, বরং কাফফারা পালন করাও বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।
ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে ফেলাঃ শরীরের অভ্যন্তরীণ কোনো কারণে যদি কেউ
অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি করে, তাহলে এতে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। তবে কেউ যদি
ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে, অর্থাৎ নিজেই চেষ্টা করে বমি আনার জন্য, তাহলে তার রোজা
ভেঙে যাবে। ইসলামে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃত বমি রোজা
নষ্টের কারণ হতে পারে এবং এর জন্য কাফফারা প্রদান করতে হবে।
ধূমপান বা অন্য কোনো নেশাদ্রব্য গ্রহণ করাঃ রোজার সময়ে ধূমপান, সিগারেট,
হুক্কা, গাঁজা, মাদকদ্রব্য বা যেকোনো ধরনের নেশাজাতীয় পদার্থ গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে
নিষিদ্ধ। এগুলো শরীরে প্রবেশ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায় এবং একই সঙ্গে কাজা ও
কাফফারা উভয়ই দিতে হয়। ইসলামে শরীরের ক্ষতি করে এমন যেকোনো বস্তু গ্রহণ নিষেধ করা
হয়েছে, বিশেষ করে রোজার সময় এটি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে।
যেসব কারণে রোজা ভঙ্গ হয় কিন্তু কাফফারা দিতে হয় না (শুধু কাজা করতে হয়)
রোজা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও সংযমের শিক্ষা
দেয়। তবে কিছু কারণে রোজা ভঙ্গ হতে পারে, কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাজা
করতে হয়, কাফফারা দিতে হয় না। এখানে এমন কিছু কারণ বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো,
যেগুলোর কারণে রোজা ভঙ্গ হলে কাফফারা লাগবে না, তবে পরবর্তীতে সেই রোজার কাজা
করতে হবেঃ
অনিচ্ছাকৃতভাবে কিছু খেয়ে ফেলাঃ যদি কেউ ভুলবশত পানাহার করে ফেলে, তাহলে
তার রোজা ভঙ্গ হবে না। কারণ এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি এবং ইসলামে ভুলের জন্য
আলাদা শাস্তির বিধান নেই। তবে কেউ যদি খাওয়ার পর মনে পড়ে যে সে রোজা ছিল, কিন্তু
তবুও খাওয়া চালিয়ে যায়, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং সেই দিনের রোজার কাজা
করতে হবে। তাই রোজাদারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো সতর্ক থাকা এবং রোজার কথা মনে
পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাবার বা পানীয় গ্রহণ বন্ধ করা।
নাক বা কান দিয়ে ওষুধ নেওয়াঃ সাধারণত রোজার মধ্যে শরীরের কোনো গহ্বর
দিয়ে কিছু প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হয়। বিশেষ করে নাক ও মুখের সংযোগ রয়েছে
পাকস্থলীর সঙ্গে, তাই নাকে ওষুধ প্রবেশ করলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হতে পারে।
একইভাবে, কানে ওষুধ বা পানি প্রবেশ করলে যদি তা গলার ভেতরে পৌঁছে যায়, তবে রোজা
ভঙ্গ হবে। তবে এ ধরনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাজা করতে হবে, কাফফারা লাগবে না।
মাসেহ বা মিসওয়াক করা অবস্থায় ভুলক্রমে পানি গিলে ফেলাঃ ইসলামে মিসওয়াক
করা সুন্নত এবং রোজার সময় এটি ব্যবহার করা বৈধ। তবে কেউ যদি ওজু করার সময়
ভুলক্রমে গলা দিয়ে পানি গিলে ফেলে, তাহলে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এটি
ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি বলে এক্ষেত্রে কাফফারা দিতে হবে না, তবে সেই রোজার কাজা
করতে হবে। তাই রোজাদারদের জন্য ওজু করার সময় সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে ভুলক্রমে
পানি গলায় চলে না যায়।
দাঁতের ফাঁকে থাকা খাবার গিলে ফেলাঃ রোজার সময় দাঁত পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। যদি দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খুব ছোট কোনো খাবার কণা অনিচ্ছাকৃতভাবে
গিলে ফেলা হয়, তবে এতে রোজা ভঙ্গ হবে না। কিন্তু যদি বড় কোনো খাবার কণা
ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেলা হয়, তাহলে রোজা ভঙ্গ হবে এবং সেই দিনের রোজার কাজা করতে
হবে। তাই রোজাদারদের উচিত দাঁত ব্রাশ বা কুলি করে মুখ পরিষ্কার রাখা, যাতে কোনো
খাবার কণা ভুলক্রমে গিলে ফেলার সম্ভাবনা না থাকে।
রোগের কারণে ইনজেকশন বা স্যালাইন নেওয়াঃ রোজা অবস্থায় কোনো ধরনের
পুষ্টিকর ইনজেকশন বা স্যালাইন গ্রহণ করলে রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়। তবে এক্ষেত্রে
রোজাদার অসুস্থ থাকায় তার জন্য রোজা রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। তাই এই পরিস্থিতিতে
কাফফারা দিতে হয় না, বরং সুস্থ হওয়ার পর শুধুমাত্র সেই দিনের রোজার কাজা করতে হয়।
যেসব কারণে রোজা মাকরুহ হয় কিন্তু ভঙ্গ হয় না
রোজা শুধুমাত্র পানাহার ও শারীরিক সংযম থেকে বিরত থাকার নাম নয়; এটি আত্মশুদ্ধি,
ধৈর্য এবং নৈতিক উন্নতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়। কিছু কাজ রয়েছে, যেগুলো
রোজার জন্য মাকরুহ বা অপছন্দনীয় হলেও তা রোজা ভঙ্গ করে না। তবে এসব কাজ রোজার
পূর্ণতা ও পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে। তাই এসব থেকে বিরত থাকা উত্তম। নিচে এ ধরনের
কিছু কাজের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো।
অতিরিক্ত কুলি করাঃ ওজু বা গোসলের সময় কুলি করা সুন্নত, তবে রোজা অবস্থায়
অতিরিক্ত কুলি করলে তা বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ, বেশি কুলি করার ফলে পানি
অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর চলে যেতে পারে, যা রোজার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ইসলামে
স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রোজার সময় অপ্রয়োজনীয়ভাবে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয়, যা
রোজার শুদ্ধতার জন্য হুমকি হতে পারে। তাই রোজাদারদের উচিত ওজু বা গোসল করার সময়
অত্যন্ত সতর্ক থাকা, যাতে ভুলবশত পানি গিলে না ফেলে।
অতিরিক্ত টুথপেস্ট বা সুগন্ধিযুক্ত মিসওয়াক ব্যবহার করাঃ রোজার সময়
টুথপেস্ট বা সুগন্ধিযুক্ত মিসওয়াক ব্যবহার মাকরুহ হিসেবে গণ্য হয়, বিশেষ করে যদি
টুথপেস্টের স্বাদ মুখের ভেতর থেকে গলায় চলে যায়। এটি রোজা নষ্ট করার সম্ভাবনা
তৈরি করতে পারে। তাই সুবহে সাদিকের আগে দাঁত ব্রাশ করে নেওয়া উত্তম, যাতে দিনের
বেলায় টুথপেস্ট ব্যবহারের প্রয়োজন না হয়। তবে শুধু মিসওয়াক করা সুন্নত এবং এটি
রোজার জন্য কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না, যদি এর সুগন্ধ বা স্বাদ গিলে ফেলা না হয়।
রাগান্বিত হওয়া ও অশ্লীল কথা বলাঃ রোজা শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকার
জন্য নয়, এটি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সংযমের একটি শিক্ষা দেয়। যারা রোজা রাখে, তাদের
জন্য রাগ, গালি-গালাজ, মিথ্যা বলা, গীবত করা এবং অশ্লীল কথা বলা থেকে বিরত থাকা
অপরিহার্য। অতিরিক্ত রাগান্বিত হওয়া বা কারো সঙ্গে ঝগড়া করা রোজার আধ্যাত্মিক
গুরুত্বকে নষ্ট করে দিতে পারে। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, “যদি কেউ তোমার সঙ্গে ঝগড়া
করতে আসে, তবে তুমি বলো, আমি রোজাদার।” এটি প্রমাণ করে যে রোজা শুধু শারীরিক সংযম
নয়, বরং এটি আত্মিক সংযমেরও পরীক্ষা।
মহিলাদের ক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গের বিশেষ কারণ
রোজা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, তবে নারীদের জন্য কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে
রোজা রাখা নিষিদ্ধ বা শিথিল করা হয়েছে। এই বিশেষ কারণগুলোতে নারীদের জন্য রোজা
ভঙ্গ করা বৈধ এবং পরবর্তী সময়ে কাজা করা আবশ্যক। এখানে নারীদের রোজা ভঙ্গের বিশেষ
কারণগুলো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো।
প্রথমত, হায়েজ (ঋতুস্রাব) ও নিফাস (প্রসূতি রক্তস্রাব)। নারীদের মাসিক
চক্র বা সন্তান জন্মের পর নির্দিষ্ট সময় ধরে যে রক্তস্রাব হয়, তা শরীয়ত অনুযায়ী
একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। ইসলামে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, হায়েজ ও
নিফাস অবস্থায় রোজা রাখা হারাম এবং এ সময় রোজা রাখলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এই
অবস্থায় রোজাদার নারীকে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে এবং শুদ্ধতার পর সেই রোজাগুলোর কাজা
করতে হবে। এটি আল্লাহর একটি বিশেষ বিধান, যা নারীদের শারীরিক ও মানসিক
স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী মায়েদের জন্য রোজার শিথিলতা। গর্ভবতী বা
স্তন্যদায়ী মা যদি মনে করেন যে রোজা রাখা তাদের নিজের স্বাস্থ্যের জন্য বা
গর্ভস্থ সন্তান বা শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাহলে তারা রোজা
ভাঙতে পারেন। ইসলামে মায়ের এবং শিশুর সুস্থতা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া
হয়েছে। তবে এই কারণে রোজা না রাখতে পারলে পরবর্তী সময়ে যখন তারা শারীরিকভাবে
সক্ষম হবেন, তখন সেই রোজাগুলোর কাজা করে নিতে হবে।
উপসংহার
রোজা ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। এটি শুধুমাত্র উপবাস থাকার
জন্য নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, সংযম ও তাকওয়া অর্জনের জন্য। তাই আমাদের সঠিক নিয়ম
মেনে রোজা পালন করা উচিত এবং এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত যা রোজার ক্ষতি
করতে পারে। উপরোক্ত আলোচনায় আমরা "রোজা ভঙ্গের কারণ কয়টি?" প্রশ্নের বিস্তারিত
ব্যাখ্যা দিয়েছি। আশা করি, এটি সবার জন্য উপকারী হবে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url